আশুগঞ্জের ওসির নেতৃত্বে মাদক ব্যবসার অভিযোগ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া, 12 May 2025, 36 বার পড়া হয়েছে,
আশুগঞ্জ প্রতিনিধি : ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুর টোলপ্লাজা এখন অবৈধ মাদক ও ভারতীয় পণ্য চোরাচালানের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের নীরব সহযোগিতায় এবং মাসোহারা বাণিজ্যের মাধ্যমে নিয়মিত ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ অবৈধ পণ্য রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বাধাহীনভাবে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
আশুগঞ্জ উপজেলার সর্বত্র এখন রমরমা মাদক ব্যবসা। হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা, ফেনসিডিল আর গাঁজা। মাদক যা ধরা পড়ছে তার সামান্যই উদ্ধার দেখানো হচ্ছে। টাকা ছাড়া কোনো মামলা হচ্ছে না থানায়। অপকীর্তির অভিযোগের শেষ নেই।

এসব কিছুর পেছনে আশুগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহা. বিল্লাল হোসেনের নাম রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত বছরের ৪ অক্টোবর যোগদানের পর থেকেই টাকা কামাতে মাদক ব্যবসাকে পুঁজি করেছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। মাদককারবারিদের নিয়ে খুলেছেন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ। চাউর আছে নিজেও ছুটে যান বিশেষ লোকদের মাদক আসরে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ১০ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেটসহ বিজয়নগরের দুই মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে আশুগঞ্জ থানা পুলিশ। পরে ৩শ ইয়াবা দিয়ে তাদের চালান দেওয়া হয়। বাকি ইয়াবা পুলিশের এক সোর্স পাখি জসিম ও বিজয়নগরের আরেক মাদককারবারির মাধ্যমে কিশোরগঞ্জের ভৈরবের জীবন মিয়া নামে আরেক মাদককারবারির কাছে বিক্রি করা হয়। আটক আনোয়ার ও রফিকুল বিজয়নগর উপজেলার চিহ্নিত বড় দুই মাদককারবারি ব্যবসায়ী।

প্রতিনিয়তই এমন ঘটনা ঘটছে। বিপুল পরিমাণ মাদক আটক করে আবার সেই মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হয়। পুলিশের কাছ থেকে মাদক ক্রেতাদের একজন শাহআলম। সোনারামপুরে তার বাড়ি।

গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, বিজয়নগরের বিষ্ণুপুর গ্রামের চিহ্নিত চোরাকারবারি হানিফ মেম্বার, জালাল, সিঙ্গারবিল গ্রামের জহির, সেতু, জসিম, চান্দুরা ইউনিয়নের আলাদাউদপুরের রহিম, শাহআলম, জালালপুরের ফজলুর রহমান প্রকাশ বজলু, আকতার হোসেন, আনোয়ার হোসেন, মাসুক এবং ভৈরবের স্বপন দাদা, ঢাকার সাইফুল চাচাসহ এমন বহু চিহ্নিত মাদক ও চোরাকারবারি এখন আশুগঞ্জ পুলিশের সঙ্গে সমঝোতায় অবৈধ পণ্য পাচার করছেন।

অভিযোগ রয়েছে আশুগঞ্জের প্রতিটি মাদকের স্পট থেকে ওসির নামে টাকা নেওয়া হয়। সে কারণে স্থানীয় কোনো মাদক ব্যবসায়ীকে আটক বা মাদক উদ্ধার করা হয় না। যা আটক করা হয় মহাসড়ক দিয়ে আশুগঞ্জ হয়ে ঢাকা বা দেশের অন্যস্থানে নিয়ে যাওয়ার সময়। থানার ওসি বা পুলিশের সঙ্গে যাদের লাইন বা টাকার চুক্তি নেই তারাই ধরা পড়ছে এখানে।

ভারতীয় জিরা ও চিনি পাচারের জন্য ট্রাক প্রতি টাকা নেন ওসি। মাদক ব্যবসায়ী ও পাচারকারীদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আশুগঞ্জের মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তার সখ্যতার বিষয়টি ওপেনসিক্রেট। রাত ১২ টার পর থেকে রাতভর মাদক ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন স্থানে মদের আড্ডায় সময় কাটান ওসি।

অপরদিকে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি এসআই ইসহাক আশুগঞ্জ থানায় যোগদানের তিনদিনের মধ্যেই টোলপ্লাজা পুলিশ ফাঁড়িতে যোগদান করেন। তারও আগে সীমান্তবর্তী বিজয়নগর থানায় কর্মরত থাকার সুবাদে মাদককারবারি এবং চোরাকারবারিদের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। এই সখ্যতাকে কাজে লাগিয়ে চোরাকারবারিরা ভারত থেকে অবৈধ পথে আসা গাঁজা, ফেনসিডিল, এসকফ সিরাপ, মদ, ইয়াবা থেকে শুরু করে কিটক্যাট চকলেট, কসমেটিকস, কাতান শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রি-পিস, জিরা, চিনি, ওষুধ, মোবাইল এবং মোবাইলের ডিসপ্লেসহ বিভিন্ন সামগ্রী নিয়মিত টোলপ্লাজা অতিক্রম করে রাজধানী ও আশপাশের জেলায় পাচার করতে এসআই ইসহাকের সঙ্গে মাসোহারার বিনিময়ে চুক্তিবদ্ধ হন।

এই টোলপ্লাজাটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সর্বশেষ চেকপয়েন্ট হওয়ায় এটির গুরুত্ব অনেক। এই পথে ভারতীয় অবৈধ পণ্য পাচার নির্বিঘ্ন করতে গাড়ি প্রতি ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়; যার একটি বড় অংশ যায় থানার ওসি মোহা. বিল্লাল হোসেনের পকেটে। এসব চোরাকারবারিদের গাড়ি ওসির নির্দেশে স্বয়ং পুলিশ সদস্যরাই আশুগঞ্জ সদরের হাইওয়ে হোটেল উজানভাটি ও রাজমনির সামনে থেকে স্কট দিয়ে পার করিয়ে দেন।

থানা সূত্রে জানা গেছে, ওসি মোহা. বিল্লাল হোসেন আশুগঞ্জ থানায় যোগদানের পর থেকে (গত বছরের ৪ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ২১ এপ্রিল) মাত্র ৮৬৯ কেজি গাঁজা, ১ হাজার ৪৩২ বোতল ফেনসিডিল, ২৭ বোতল স্কাপ, ২৪ বোতল হুইস্কি, ৩৫৪ বোতল বিদেশি মদ ও ৩৫ হাজার ১৩২ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট আটক করা হয়। এসব মাদকের বিপরীতে ১৬২ জনকে গ্রেফতার এবং ১০৬টি মামলা দেওয়া হয়।

শুধু মাদক নয়, আশুগঞ্জ রেলস্টেশনকেন্দ্রিক ছিনতাইকারী চক্রের সঙ্গে সখ্যতার অভিযোগ ওসির বিরুদ্ধে। গত ২৪ মার্চ সিলেট থেকে ঢাকা যাওয়ার সময় এক ছেলের কাছ থেকে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটে। ছিনতাইকারীর কাছ থেকে মোবাইল উদ্ধার করলেও ছিনতাইকারীকে আটক করেনি পুলিশ। এছাড়া সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুতে দিনের বেলায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও সেই ব্যাপারে নির্বিকার পুলিশ।

আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাছির মুন্সি ও উপজেলা বিএনপির ত্রাণ ও পুনর্বাসন সম্পাদক ফয়সালকে গত ১ মার্চ মারধর করা হয়। সেই মামলা নিতে ফয়সালের কাছে ২ লাখ টাকা দাবি করেন ওসি। টাকা না দেওয়ায় মামলা নেওয়া হয়নি।

আশুগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের সাবেক সদস্য সচিব শাহিন আলম বকশির কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা নেন ওসি। গ্রেফতার করা হবে না বলে কৃষক লীগের বর্তমান সভাপতি নজরুল ইসলাম বকুলের কাছ থেকে ২ লাখ টাকা নেন। পরে অবশ্য ডিবি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। তারপরও ওসি তার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে বলেন আর কোনো মামলা দিবেন না। যুবলীগ নেতা শাহীন মুন্সির কাছ থেকেও ওসি নেন ৭০ হাজার টাকা।

মোট কথা ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকার নিচে কোনো মামলা রেকর্ড করেন না ওসি। মামলা হলেও আসামিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের গ্রেফতার করেন না। অনেক আসামিই প্রকাশ্যে ঘুরছেন।

আশুগঞ্জে আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের গ্রেফতারের কথা বলে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা আদায় করেন; কিন্তু এ ব্যাপারে ভয়ে মুখ খোলেন না অনেকে।

এছাড়া কোনো নেতাকে র্যাব অথবা অন্য কোনো বাহিনী গ্রেফতার করলেও আসামিকে একের অধিক মামলায় আটক দেখানো হবে ভয় দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। পুরো উপজেলায় রয়েছে তার দালাল বাহিনী। এর মধ্যে সোর্স জসিমের মাধ্যমে উপজেলায় গ্রেফতার বাণিজ্য ও মাসিক মাসোহারা নিয়ন্ত্রণ করেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে আশুগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহা. বিল্লাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মাদককারবারিদের সহযোগিতার বিষয়টি সত্য নয়। টোলপ্লাজা থেকে মাদক বা অবৈধ পণ্য পাওয়া গেলে মামলা দেওয়া হয়। মাদকের সঙ্গে আমার কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই।

পুলিশ সুপার এহতেশামুল হক বলেন, মাদকের সঙ্গে পুলিশের সম্পৃক্ততার বিষয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Hello world!

13 January 2025, 16523 বার পড়া হয়েছে,