শেখ কামাল উদ্দিন : বজ্রপাতে মারা যাওয়ার মূল কারণ হলো বিদ্যুৎ প্রবাহ বা তীব্র তাপ ও শক। যখন বজ্রপাত হয়, তখন সেটি বিশাল মাত্রার বিদ্যুৎ (সাধারণত ৩০০ কোটি ভোল্ট পর্যন্ত হতে পারে) এবং প্রচণ্ড উত্তাপ (৩০,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি) সৃষ্টি করে। এ ধরনের শক্তি যদি কোনো মানুষ বা জীবিত প্রাণীর শরীরে সরাসরি লাগে, তখন এক বা একাধিক কারণে মৃত্যু হতে পারে:
১। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট (হৃদযন্ত্রের হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া): বিদ্যুতের শক হার্টের স্বাভাবিক রিদম নষ্ট করে দেয়। ফলে হৃদপিণ্ড আর রক্ত পাম্প করতে পারে না, সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হতে পারে।
২। নিউরোলজিক্যাল শক: মস্তিষ্ক বা নার্ভ সিস্টেমে তীব্র আঘাত লাগে, ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস থেমে যেতে পারে।
৩। অভ্যন্তরীণ অঙ্গের পুড়ে যাওয়া: বজ্রপাতের উচ্চ তাপ শরীরের ভেতরের টিস্যু ও অঙ্গগুলো পুড়িয়ে দেয়, যা জীবনঘাতী হতে পারে।
৪। বাহ্যিক পুড়ে যাওয়া বা ক্ষত: চামড়া এবং শরীরের বাইরের অংশও পুড়ে যায়, যা শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে বাধা দেয়।
৫। দ্বিতীয় আঘাত: বজ্রপাতের কারণে মানুষ যদি পড়ে যায় বা কোনো শক্ত জিনিসের সাথে ধাক্কা খায় (যেমন গাছ, দালান, ইত্যাদি), তখনও মারাত্মক আঘাত লাগতে পারে।
৬। অনেক সময় বজ্রপাত সরাসরি না লেগেও আশেপাশে পড়ে তৈরি হওয়া “গ্রাউন্ড কারেন্ট” বা “সারফেস কারেন্ট” মানুষের শরীরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং তা মারাত্মক প্রাণঘাতী হতে পারে।
বজ্রপাত থেকে বাঁচার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনুসরণ করতে হয়।
ক. বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠ, ধানক্ষেত, খোলা রাস্তা, নদীর ধারে থাকলে বিপদ বেশি। এগুলো এড়িয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যান।
খ. কোনো গাছের নিচে দাঁড়ানো ঠিক নয়, বিশেষ করে একা দাঁড়িয়ে থাকা বড় গাছের নিচে বিপদজনক।
গ. দ্রুত ঘরের ভেতর বা কোনো শক্ত কাঠামোর আশ্রয় নেওয়া
গাড়ির ভেতর থাকা তুলনামূলক নিরাপদ (ধাতব গাড়ির কাঠামো বিদ্যুৎ বাইরে দিয়ে সরিয়ে দেয়)। কাঁচের জানালা-দরজা বন্ধ রাখতে হবে।
ঘ. বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় মোবাইল ফোন চার্জ দেওয়া, টেলিভিশন, ফ্রিজ, কম্পিউটার ব্যবহার বন্ধ করা উচিত।
ঙ. বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে সরাসরি সংযুক্ত কোনো তার বা মেশিন স্পর্শ করা বিপদজনক। পানি ও ভেজা জায়গা এড়িয়ে চলা ভালো। নদী, পুকুর, সুইমিং পুল ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে হবে। ভেজা মাটি বা জলাবদ্ধ জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা বিপজ্জনক।
চ. বজ্রপাতের সময় শরীরের আকৃতি ছোট করা যেতে পারে। যদি বাইরে আটকা পড়েন এবং আশেপাশে আশ্রয় না থাকে, হাঁটু গেড়ে বসে মাথা নিচু করে শরীরকে ছোট করতে হবে। মাটির সঙ্গে সমান হয়ে শুয়ে পড়া উচিত নয় (কারণ তাতে কারেন্ট আরও সহজে প্রবাহিত হতে পারে)।
ছ. ধাতব বস্তু এড়িয়ে চলতে হবে। ছাতা, গলায় চেন, হাতঘড়ি, মোবাইল ফোন, ধাতব রড বা বাইসাইকেল সঙ্গে থাকলে তা তাড়াতাড়ি ফেলে দিতে হবে বা নিজেকে তা থেকে দূরে রাখতে হবে।
জ. “৩০-৩০ নিয়ম” মেনে চলতে হবে । বজ্রের আলো দেখার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে যদি বজ্রের শব্দ শুনতে পান, তাহলে বুঝতে হবে আপনি বিপদজনক দূরত্বের মধ্যে আছেন। তখনই নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হবে।
বজ্রপাত শেষ হওয়ার অন্তত ৩০ মিনিট পর পর্যন্ত বাইরে বের না হওয়াই ভালো।
করণীয়:
১। সরকারি অফিস, স্কুল, হাসপাতাল, বড় বাজার, মাঠে বজ্রনিরোধক রড (Lightning Arrester) বসানো।
২। খোলা মাঠে, হাটবাজারে উঁচু বজ্রনিরোধক টাওয়ার তৈরি করা যাতে বজ্রপাত নিরাপদে মাটিতে নেমে যেতে পারে।
৩। সচেতন করার জন্য প্রোগ্রাম গ্রহণ করা।
৪। কোন এলাকায় সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় তার মানচিত্র (Lightning Risk Map) তৈরি করা। বজ্রপাতে মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে সেই অনুযায়ী টার্গেটেড কর্মসূচি গ্রহণ করা।
৫। খোলা মাঠে আশ্রয়কেন্দ্র গ্রহণ করা।